‘আমি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি তখন মা-বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর মধ্যেই বিয়ে দিতে হয় এক বোনকে। বড় দুই ভাই আলাদা সংসার পেতেছেন। অসুস্থ মা-বাবা আর ছোট বোনকে দেখার কেউ থাকে না। ওই সময় সংসারের ভার কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য হই। ফলে ভাগ্যে আর লেখাপড়া হয়নি।’
কথাগুলো বলছিলেন বরিশালের গৌরনদী উপজেলার উত্তর পালরদী গ্রামের দরিদ্র দিনমজুর সাদেক হাওলাদারের পুত্র সাইফুল ইসলাম শিপন। তিনি এখন ঘেটুপুত্র কমলা রানী নামে সবার কাছে পরিচিত। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। অসুস্থ মা-বাবা আর ছোট বোনকে নিয়ে চার সদস্যের সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম শিপন।
বাংলার লোকজ সংস্কৃতির বিলুপ্তপ্রায় গাজী কালু চম্পাবতী মঞ্চনাটকে সেই পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় ঘেটুপুত্র কমলা রানী সেজে অভিনয় শুরু করে শিপনের বয়স এখন ২৫ বছর। পরিবারের সদস্যদের মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দিতে শিপন মেয়ে সেজে মানুষকে বিনোদন দিয়ে আসছেন।
তাঁর আয় দিয়ে চলে মা-বাবার চিকিৎসা ও সংসারের খরচ। এটাই এখন শিপনের রোজগারের একমাত্র পথ। বিয়ে, জন্মদিন, এলাকায় কোনো মঞ্চনাটক হলে ডাক পড়ে এ যুগের ঘেটুপুত্র কমলা রানী শিপনের।
জমিদার আমলে আমাদের এ অঞ্চলে বিশেষ নৃত্যগীতের প্রচলন ছিল। সেসব নৃত্যগীতে কোনো মেয়ে নাচ-গান করত না। ছেলেকে মেয়ে সাজিয়ে জমিদারের সামনে নাচানো হতো। মেয়ে সাজে ওই কিশোরদেরই বলা হয় ঘেটুপুত্র।
বরেণ্য লেখক হুমায়ূন আহমেদের ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ সিনেমায় অনেকে ঘেটুপুত্র কমলাকে দেখেছেন। তবে এ যুগের ঘেটুপুত্র কমলা রানীর কাহিনি কিছুটা ভিন্ন। বিনোদনের অন্তরালে রয়েছে অনেক দুঃখগাথা।
শিপন বলেন, ‘প্রথম দিকে বিড়ির কারখানায় কাজ করতাম। ওই সময় সমবয়সীদের সঙ্গে প্রায় রাতে গাজী কালু চম্পাবতী নাটক দেখতে যেতাম। শীত মৌসুমে আমাদের গ্রামে প্রায় বাড়িতে রাতে গাজী কালু চম্পাবতী নাটক হতো। নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো সবাই সে নাটক দেখত।
সেই থেকে ধীরে ধীরে এই পেশায় জড়িয়ে পড়ি। বলতে পারেন এটাই এখন আমার পেশা। পেটের দায়ে এই পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছি। গাঢ় মেকআপের তলে জড়িয়ে আছে আমার পরিবারের জীবন-জীবিকা।’
একটু দম নেন শিপন। এরপর আবার বলতে থাকেন, ‘১৫ বছর নিজের সব দুঃখ-কষ্ট চেপে রেখে মানুষকে বিনোদন দিয়ে আসছি। অনুষ্ঠানপ্রতি আয় ৬০০ থেকে এক হাজার টাকা। করোনার কারণে বন্ধ ছিল অনেক দিন। তবে এখন আর কোনো মঞ্চের অনুষ্ঠানে যেতে চাই না। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে।’
স্থানীয় যাত্রাশিল্পী বশির ইসলাম জানান, ছেলে হলেও শিপন এখন কমলা রানী নামে অধিক পরিচিত। করোনার আগে ঝালকাঠির নবগ্রামে এক অনুষ্ঠানে কমলা রানীর নাচ দেখে এক ব্যক্তি তো বিয়েরই প্রস্তাব দিয়ে বসেন। তিনি বিশ্বাসই করছিলেন না শিপন মেয়ে নয়, ছেলে।