অনিল চন্দ্র রায়, কুড়িগ্রাম থেকে: করোনা মহামারীতে স্কুল বন্ধ থাকায় তার সব বান্ধবী বাল্যবিয়ের শিকার। বান্ধবীদের বিয়ে হওয়ায় এখন শ্রেণিকক্ষে আর নেই কোন বান্ধবী।
১২ সেপ্টেম্বর থেকে নারী শিক্ষার্থী হিসেবে শ্রেণিকক্ষে একাই ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে পাঠ গ্রহন করছেন নার্গিস নাহার। এখন তার মনের অবস্থাও খুব বেশি ভালো নেই। তার মনের জমানো কথা খোলামেলা আলোচনা করার কেউ নেই একই শ্রেণিতে। হতাশাও কাজ করছে তার মাঝে।
শত হতাশার মাঝেও সে লড়াই সংগ্রাম করে পড়াশুনায় আরো বেশি মনোযোগী হতে দৃঢ় পণ করেছেন চর এলাকার লড়াকু নার্গিস। চরে তার পরিচিতি হয়েছে একজন সংগ্রমী ও প্রগতি চিন্তার নারী শিক্ষার্থী হিসেবে।
পড়াশুনা করে প্রতিষ্ঠিত হতে চান তিনি। হতে চান একজন আদর্শবান আইনজীবী। সুযোগ পেলে তিনি পৌঁছতে পারবেন তার গন্তব্যে। এ জন্য তিনি সবার সহযোগীতা চেয়েছেন। নার্গিস নাহারের বাড়ী উত্তরের সীমান্তঘেষা জেলা কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের ধরলা নদীপাড়ের সারডোব গ্রামে।
তিনি ঐ এলাকার আব্দুল খালেকের শেয়ে ও সারডোব উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। ঐ প্রতিষ্ঠানে নার্গিস নাহারের ছেলে বন্ধু রয়েছেন ২৭ জন। নানা কুসংস্কারে ঢেকে থাকা এই গ্রামে বাল্য বিয়ে একটি জটিল সমস্যায় পরিনত হয়েছে।
সারডোব গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত কৃষক আব্দুল খালেক- রোশনা বেগম দম্পতির ছোট মেয়ে নার্গিস নাহার। এই গ্রামে নারী শিক্ষার্থীর হার খুবই কম হলেও নার্গিস নাহারের বড় দুই বোন খালেদা আখতার ও লাইজু খাতুন এইচএসসি পাস করার পর বিয়েরপিঁড়িতে বসেছেন। নার্গিস নাহারের স্বপ্ন আরো বেশি পড়াশুনা করে প্রতিষ্ঠিত হবেন।
ভাই না থাকায় সংসারের হাল ধরারও ইচ্ছা আছে তার। ‘আমার স্বপ্ন একজন আইনজীবী হওয়ার। আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারলে আমাদের এলাকায় বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে পারবো’- বিডি২৪লাইভকে বলছিলেন নার্গিস। ‘আমি বাবা-মাকে জানিয়েছি আগে পড়াশুনা শেষ করবো তারপর কর্মজীবন শুরু করবো এবং পরে বিয়ের কথা ভাববো। আমাদের গ্রামে বাল্যবিয়ে একটি জটিল সমস্যায় পরিনত হয়েছে বলেও আক্ষেপ করেন নার্গিস।
নার্গিস নাহারের বাবা আব্দুল খালেক জানান, ‘নার্গিস পড়াশুনার পাশাপাশি সংসারের সকল কাজ করে। সবজি খেতের পরিচর্যা এবং গরু-ছাগলকে খাবার দেওয়া তার নিত্য দিনের রুটিন। সে আমাদের সাথে সর্বদা মতবিনিময় করে। উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার জন্য আমাদের কাছে সবসময় বায়না ধরে। নার্গিসের স্বপ্ন তিনি একজন আইনজীবী হবেন। কিন্তু আমি নিম্নবিত্ত কৃষক আর আমার আর্থিক অবস্থা খুবই শোচনীয়। অধিকাংশ জমিই চলে গেছে ধরলা নদীর উদরে। রয়েছে শুধু বসতভিটা ও সামান্য কিছু আবাদি জমি। সবাই আমার মেয়েটার জন্য দোয়া করবেন।’
স্থানীয ইউপি সদস্য মো. বাহিনুর ইসলাম বলেন, সারডোব গ্রামের ১৭ থেকে ১৮ হাজার মানুষের শতভাগ বন্যা ও নদীভাঙনে শিকার। দারিদ্রতা এখানে নিত্য দিনের সঙ্গী । কন্যা সন্তানদের নিয়ে কুসংস্কারও রয়েছে এই গ্রামে। বাল্য বিয়ে দেওয়া এখানকার রীতিতে পরিনত হয়েছে। তবে এসব বাল্য বিয়ের অধিকাংশই দেওয়া হচ্ছে গোপনে ‘আমরা সচেতনতা বাড়াতে প্রচারনা চালাচ্ছি কিন্তু কোন কাজে আসছে না। ‘নার্গিস নাহার আমাদের চরে এখন লড়াকু স্কুলছাত্রী। সে এখন নারী শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরনার দৃষ্টান্ত।
এ প্রসঙ্গে সারডোব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো.ফজলে রহমান সরকার জানান, বাল্য বিয়ের কবলে পড়া নারী শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর নিয়েছেন শিক্ষকরা। তাদের বিদ্যালয়ে ফিরে আনতে চেষ্টাও করছেন। গ্রামে অভিভাবকদের মাঝে চালাচ্ছেন বাল্য বিয়ের বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে জনসচেতনতামুলক প্রচার- প্রচারনা। শ্রেণীকক্ষে নার্গিস নাহার যেন হতাশ না হয় সেজন্য তাকে মানসিবভাবে সাহস ও উৎসাহ যোগানো হচ্ছে। নার্গিস যেভাবে সংগ্রমী ও প্রগতি চিন্তার ব্রতী হয়ে পড়াশুনা করছে তাতে সে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।