প্রকল্পের সভাপতিদের স্বাক্ষর জালিয়াতি, কাজ না করেই বিল উত্তোলন, প্রকল্পের অর্থ ছাড়ে ঘুষ নেয়াসহ নানা অভিযোগ উঠেছে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে। তিনি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার দায়িত্বে আছেন। ওই কর্মকর্তা মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, ঈদগাহ্ মাঠ ও এতিমখানাসহ টিআর সাধারণ প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রায় ৬৭ লাখ টাকা কৌশলে লোপাট করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্প সভাপতিদের অনেকেই বরাদ্দের কথা জানেন না। ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত অর্থে বাস্তবায়িত মুক্তিযোদ্ধাদের ঘর (বীর নিবাস), ছোট-বড় সেতু নির্মাণ, হেরিং বন বন্ড, কাবিখা, কাবিটা সাধারণ ও বিশেষ এবং টিআর সাধারণ ও বিশেষ প্রকল্পে এই অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়াও স্থানীয় পলাশবাড়ী উপজেলার বেতকাপা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আব্দুর রাজ্জাক লালু বলেন, কাজ করার পর বিল নিতে গেলে পিআইওকে দশ শতাংশ হারে ঘুষ প্রদান করতে হয়। ইতিমধ্যেই তিনি চার লাখ টাকার কাজ করে বিল নিতে গিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রেজাউল করিমকে ৪০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে দাবি করেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর টাকা) কর্মসূচির সাধারণ প্রথম পর্যায়ে (ক্রমিক নম্বর-১৫) পলাশবাড়ী উপজেলার মহদীপুর ইউনিয়নের দুর্গাপুর কর্মকারপাড়া দুর্গা মন্দির সংস্কারে বরাদ্দ দেয়া হয় এক লাখ ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু সেখানে মাত্র ১৫ হাজার টাকা হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। দুর্গা মন্দিরের সেক্রেটারি সুনিল চন্দ্র কর্মকার বলেন, পলাশবাড়ী পিআইও অফিসের আনিছ আমার হাতে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছেন। বরাদ্দ কত টাকা তা জানানো হয়নি।
সেই সামান্য টাকায় মন্দিরের উন্নয়নমূলক কাজ করেছি। এদিকে একই অর্থবছরে টিআর সাধারণ প্রথম পর্যায়ে (তালিকার ক্রমিক নম্বর-১৬) একই গ্রামের মুকুল চন্দ্র শীলের বাড়ির দুর্গা মন্দির সংস্কারে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও মন্দির সংশ্লিষ্টরা টাকা পেয়েছেন মাত্র ২০ হাজার। মন্দির কমিটির সভাপতি ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি প্রহল্লাদ চন্দ্র শীল বলেন, কয়েক মাস আগে পিআইও অফিসের অফিস সহকারী আনিছুর রহমান মন্দিরের উন্নয়নমূলক কাজ করার জন্য আমার হাতে ২০ হাজার টাকা দেন। এজন্য ছবিসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও নেন তিনি।
এমনকি ব্যাংকের চেকসহ বেশ কয়েক জায়গায় আমার স্বাক্ষরও নেয়া হয়। অন্যদিকে, ২০২১-২২ অর্থবছরে টিআর সাধারণ দ্বিতীয় পর্যায়ে আওতায় পলাশবাড়ী বেতকাপা ইউনিয়নের বেতকাপা যদু সরকারের বাড়ির দুর্গা মন্দির সংস্কারে (ক্রমিক নম্বর-৭) বরাদ্দ দেয়া হয় এক লাখ ৯৪ হাজার ২০১ টাকা। কিন্তু এই মন্দির সংস্কারে কোনো টাকা পাননি বলে জানালেন যদু সরকারের নাতি মন্দির কমিটির সহ-সভাপতি উত্তম কুমার সরকার। মন্দির কমিটির সভাপতি ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি স্বপন চন্দ্র বলেন, কয়েক মাস আগে স্থানীয় ফারুক মেম্বার মন্দিরের নামে বরাদ্দ আনার কথা বলে আমার কাছে থেকে কাগজপত্র নেন। কয়েকদিন পর উপজেলার একটি অফিসে নিয়ে গিয়ে কয়েক জায়গায় স্বাক্ষর নেন। কিন্তু কোনো টাকা দেননি।
২০২১-২০২২ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর টাকা) কর্মসূচির সাধারণ দ্বিতীয় পর্যায়ের আওতায় (প্রকল্প তালিকার ক্রমিক নম্বর-৩৫) পলাশবাড়ী উপজেলার হরিনাথপুর ইউনিয়নের মরাদাতেয়া ব্রিজ হতে শুরু করে গোফফার মেম্বরের বাড়ী পর্যন্ত রাস্তা মেরামতে বরাদ্ধ দেয়া হয় দুই লাখ টাকা। কিন্তু এই প্রকল্পে কোন কাজ করাই হয়নি। স্থানীয় সাবেক মেম্বর আব্দুল কাদের মন্ডল বলেন, এই আসনের সংসদ সদস্য সংশোধনী বরাদ্দে কাবিখা প্রথম পর্যায়ের আওতায় টাকিয়ার বাজার থেকে নালার বাতা (মরাদাতেয়া ব্রিজ) পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারে ৯ টন গম বরাদ্দ দেন। প্রকল্প সভাপতি স্থানীয় সরকার দলের নেতা আবু রেজা মো. আমিনুল ইসলাম নামমাত্র কাজ করে বরাদ্দের গম উত্তোলন করেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, টাকিয়ার বাজার থেকে দক্ষিণে নালার বাতা বা মরাদাতেয়া ব্রিজ পর্যন্ত কোনো রকমে এমপি’র কাবিখা প্রথম পর্যায়ের বরাদ্দে মাটির কাজ করা হয়েছে। সেই ব্রিজ থেকে উত্তরে গোফফার মেম্বারের বাড়ি পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় বরাদ্দ দিয়ে পুরো টাকা গায়েব করা হয়েছে। প্রকল্প সভাপতি সংরক্ষিত নারী সদস্য রাশেদা বেগম বলেন, এই প্রকল্প সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।
ওই প্রকল্পে কোনো মাটির কাজও হয়নি। আমার স্বাক্ষর জাল করে বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। একই উপজেলার টিআর সাধারণ দ্বিতীয় পর্যায়ের আওতায় (তালিকার ক্রমিক নম্বর-৬) হোসেনপুর ইউনিয়নের মধ্য রামচন্দ্রপুর গ্রামের ময়েজ উদ্দিনের ঈদগাহ্ মাঠ সংস্কারে বরাদ্দ দেয়া হয় ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩ টাকা ৭৪ পয়সা। কিন্তু এই ঈদগাহ্ মাঠে একটি টাকাও পায়নি সংশ্লিষ্টরা। ঈদগাহ্ মাঠ সভাপতি ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি হাবিবুর রহমান বলেন, দুই বছরের মধ্যে সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা এই মাঠের জন্য আমরা পাইনি। এদিকে একই অর্থবছরে টিআর সাধারণ প্রথম পর্যায়ে একই গ্রামের সেলিমের বাড়ির পাশে ঈদগাহ্ মাঠ সংস্কারে ২ লাখ ২৮ হাজার ১ টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও সেখানেও কোনো টাকা পৌঁছেনি। ওই প্রকল্পে কাগজ-কলমে সভাপতি দেখানো হয়েছে ঈদগাহ্ মাঠের ইমাম সাফী হুজুরকে। তিনি দুই বছর আগে ওই মাঠের ইমামতি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। ২০২১-২২ অর্থবছরে টিআর সাধারণ দ্বিতীয় পর্যায়ে আওতায় পলাশবাড়ী হোসেনপুর ইউনিয়নের কদমতলী আল- কোরআন হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও লিল্লাহ বোর্ডিং সংস্কারে (ক্রমিক নম্বর-৭) বরাদ্দ দেয়া হয় ২ লাখ টাকা। কিন্তু এই মাদ্রাসা সংস্কারে কোনো টাকা পাননি বলে জানালেন শিক্ষক খোরশেদ আলম। তিনি অভিযোগ করেন, এই প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রে আমাকে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি দেখানো হলেও আমি কিছুই জানি না। এখানে আমার স্বাক্ষর জাল করে বরাদ্দকৃত টাকা উত্তোলন-পূর্বক আত্মসাৎ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আনিছুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, আমার বাড়ির কাছের দুর্গাপুর শীলপাড়া ও কর্মকারপাড়ার দু’টি মন্দিরের টাকা তুলে প্রকল্পের সভাপতিদের হাতে দিয়েছি। তারা কিছু কাজ বাকি রেখেছিল। এরমধ্যে ধান কাটা-মাড়াই শুরু হলে কাজ করতে একটু দেরি হয়েছে। এখন কাজগুলো শেষ হয়েছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) রেজাউল করিম বলেন, প্রকল্পগুলোর কোথাও কোনো ধরনের দুর্নীতি হয়নি। কারো স্বাক্ষরও জাল করা হয়নি। প্রকল্পগুলোর কমিটির মাধ্যমে কাজগুলো যথাযথভাবে করা হয়েছে। যারা অভিযোগগুলো করেছেন তারা মিথ্যা বলেছেন।