চার বছর আগে পরিবারের সুখের জন্য সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছিলেন সরাইলের শাহজাদাপুর গ্রামের আলমগীর খানের ছেলে আরেফিন খান (৩২)। সম্প্রতি দেশে আসার সকল আয়োজনও সম্পন্ন করেছিল। কিন্তু সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে গত ২রা জুন খুুন হয় আরেফিন। তার আপন মামা মোরছালিন চৌধুরীর সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় ১লা জুলাই বুধবার। খুনের ১ মাস পর গত ১১ই জুলাই পরিবার জানতে পারে আরেফিন আর বেঁচে নেই। এরমধ্যে মৃত্যুর খবরটি কফিল বা সহকর্মী কেউই জানাননি। ফারুক কেন প্রথমে জেলখানায় ও পরে বললেন শুক্রবারে মারা গেছে? একই কক্ষে থেকেও ছাদেক কেন মৃত্যুর খবরটি বাড়িতে জানায়নি? এমন সব প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে আরেফিনের পরিবার ও স্বজনদের মনে। তরতাজা ছেলে খুনের খবরে বাকরূদ্ধ হয়ে বিছানায় পড়ে গেছেন আরেফিনের মা বাবা। শান্ত্বনা দেয়ার সাধ্য যে কারও নেই। ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে পরিবারের সকল স্বপ্ন।
সমগ্র গ্রাম জুড়ে চলছে শোকের মাতম। মায়ের আকুতি একটাই শেষবারের মতো আমার ছেলের লাশটি দেখতে চাই। চেষ্টা চলছে। লাশ আনতে জমি বিক্রি করছেন পিতা। নিহত আরেফিনের পরিবার, স্বজন ও এলাকাবাসীর সূত্র জানায়, চার ভাইয়ের মধ্যে আরেফিন সবার বড়। সেই ছিল পরিবারের মূল ভরসা। পরিবারের সকলের সুখের কথা ভেবেই ৪ বছর আগে ফ্রি ভিসায় গিয়েছিল সৌদী আরবে। মধ্যস্থতা করেছিলেন ওই গ্রামের ফরুক মিয়া নামের এক ব্যক্তি। তার কফিল ছিল। নিয়মিত কাজ করতো। ইনকামও ছিল ভালো। সেখানে ভালোই কাটছিল তার দিনকাল। প্রতি মাসেই বাড়িতে টাকা পাঠাতো। কিছুটা স্বচ্ছলতাও ফিরে এসেছিল তাদের সংসারে। পরিবারের সকল সদস্যই আরেফিনকে ঘিরে স্বপ্ন দেখতো। দেখতে দেখতে চলে গেছে ৪ বছর। আরেফিনের হাতে জমা ছিল ২০-২৫ লাখ টাকা। এই টাকাটাই যে কাল হলো তার। তার হাতে টাকা দেখে সেখানে বাংলাদেশের একটি দুস্কৃতিকারী দালাল সিন্ডিকেট তার পিছনে লাগে। লোভ দেখায় ইটালি নেয়ার। সেই ফাঁদে পা দেয় আরেফিন। ইউরোপ কান্ট্রির প্রলোভন দেখিয়ে খাতিয়ে নেয় অনেক টাকা। বর্ডার পাড় করে ইতালি নেয়ার উদ্যেশ্যে রওনা দেয়। ব্যর্থ হয়ে প্রচণ্ড গরমে উত্তপ্ত মরুভূমিতে আরেফিনকে ফেলে আসে। সেখানে সীমাহীন দুর্ভোগ ও কষ্টে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। এক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আরেফিন। মৃত্যুর তিনদিন পর আরেফিনের লাশ উদ্ধার করে রাফা সেন্ট্রাল হাসাপাতালের হিমাগারে রাখে সেই দেশের পুলিশ। সেখানকার একটি মেডিকেল রিপোর্টে বলা হয়েছে-‘মৃত্যুর কারণ অজানা। তবে শ্বাস প্রশ্বাসে কষ্টে মৃত্যু হয়েছে।’ মৃত্যুর খবরটি সৌদী দূতাবাস, কফিল বা তার কোনো সহকর্মী আরেফিনের পরিবারকে জানায়নি। তার মামা মোরছালিন জানান, মুঠোফোনে তার সঙ্গে নিয়মিতই কথা বলতাম। বেশ কিছুদিন আফরিনের ফোনটি বন্ধ পাচ্ছি। তার মাকে বিষয়টি জানালাম। তিনিও বন্ধ পেলেন। মধ্যস্থতাকারী বর্তমানে সোদী প্রবাসী ফারুককে ফোন দিলেন। ফরুক জানিয়েছে, আরেফিন বর্ডারে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। আমরা সকলেই টেনশনে পড়ে যাই। মাসহ পরিবারে কান্নার রোল। অপেক্ষায় থাকি। এক সময় তো জামিন পাবেই। নিয়মিত দালালের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। ফরুকসহ সকলেই বারবার জানায় জেলখানায় আছে। ১০ই জুলাই রাতে এডভোকেট সোহেল খাদেমকে প্রথম মৃত্যুর সংবাদ দেয় তার এক স্বজন। পরদিন ১১ই জুলাই আমরা জানতে পারি। আকাশ ভেঙে পড়ে গোটা পরিবার ও স্বজনদের মাথায়। আরেফিনকে যারা সৌদীতে নিয়েছে তাদের সিন্ডিকেটের চক্রই ইউরোপ কান্ট্রিতে নেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে টাকা লুটে নিয়ে মরুভূমিতে ফেলে এসেছে। সেখানে অনেক কষ্ট ও যন্ত্রণায় ছটফট করে এক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আরেফিনের একাধিক স্বজন ও অন্য একটি সূত্র জানায়, শাহজাদাপুর গ্রামের তাহের মিয়ার ছেলে ছাদেক। ছাদেক আর আরেফিন ক্লাসমেট। সৌদী আরবে তারা দুইজন থাকতো একই কক্ষে। আরেফিনকে মরুভূমিতে নিয়ে গিয়েছিল ছাদেকের (৩৫) গাড়িতে করে। খাবার ও পানি শেষ। যন্ত্রণায় নিরূপায়। তখন আরেফিন ছাদেকের মুঠোফোনে ৭০-৮০ বার কল দিয়েছে। অনেকগুলো ভয়েস ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। ম্যাসেজে আরেফিনের বাঁচার আকুতি ছিল। বলেছিল, ‘আমি খুবই কষ্টে আছি। পানি শেষ। তৃষ্ণায় বুক ফেঁটে যাচ্ছে। দুর্বল হয়ে গেছি। আমি মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছি। ছাদেক তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাও। আমাকে তুমি বাঁচাও। ঘুমিয়ে থাকায় ছাদেক আরেফিনের আকুতির ভয়েস এসএমএসগুলো বুঝতে ও শুনতে পারেনি। ঘুম থেকে জেগে ছাদেক রওনা দেয় মরুভূমির দিকে। সেখানে যাওয়ার পরই পুলিশ গাড়িসহ ছাদেককে গ্রেপ্তার করে। ছাদেকের কপিল ছাড়িয়ে এনে দেশে পাঠিয়েছেন। ৩/৪ দিন আগে ছাদেক বাংলাদেশে আসলেও এখনো সাক্ষাৎ করেনি আরেফিনের মা-বাবা বা কোনো স্বজনের সঙ্গে। নিহত আরেফিনের মা মোছাম্মৎ বিউটি বেগম ও বাবা আলমগীর খান বলেন, আমাদের সব শেষ। এমন সর্বনাশ কে করলো? ছোট ছেলেদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাবে। একই গ্রামের বাসিন্দা হয়েও ফরুক ও ছাদেক কেন আরেফিনের মৃত্যুর সংবাদটি আমাদেরকে দিলো না? আমাদের ছেলেকে টাকা পয়সা লুটে নিয়ে কৌশলে মেরে ফেলেছে। বিচার চাই। ছেলের লাশটি দ্রুত দেশে আনতে সরকারের সহায়তা চাই। সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আরিফুল হক মৃদুল বলেন, ঘটনাটি আমাদের জানা নেই। তবে লাশ আনতে কাগজপত্রে যে সহযোগিতার প্রয়োজন সেটা আমরা করে থাকি।